সৌদি আরব কি ফিলিস্তিনের পরম বন্ধুতে পরিণত হতে যাচ্ছে?
সৌদি আরব যেভাবে ফিলিস্তিন প্রশ্নে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে
লেখা:
ডেভিড হার্স্ট
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সৌদি আরবের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন বলে দাবি করেছিলেন। বহু বছর ধরে গড়া সম্পর্ক মাত্র কয়েক দিনে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। সৌদি রাজতন্ত্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক কেবল রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেনি, বরং ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষও এতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) একসময় রাজপরিবারের শক্তিশালী সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মুখে ছিলেন। তখন তিনি বুঝতে পারেন যে ক্ষমতার পথ সুগম করতে হলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেতে হবে। ২০১৭ সালে তিনি গোপনে ইসরায়েল সফর করে প্রভাবশালী ইহুদি গোষ্ঠীর মন জয়ের চেষ্টা চালান। ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রকাশ্য অবজ্ঞা দেখিয়ে তিনি পশ্চিমা বিশ্বকে আকর্ষণ করেন।ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দিয়ে গাজাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। আর জানান যে গাজা পুনর্গঠনের খরচ বহন করবে উপসাগরীয় দেশগুলো, অর্থাৎ মূলত সৌদি আরব। এই দাবি সৌদি আরবের জন্য বিশেষভাবে অপমানজনক ছিল। এ ছাড়া ট্রাম্প দম্ভের সঙ্গে বলেন যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের দাবি ছাড়াই সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। কিন্তু এই বক্তব্যের ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সৌদি আরব এর জবাব দেয়। এতে স্পষ্ট জানানো হয়, সৌদি আরব নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে, যাতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ছাড়া সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে না।
এর জবাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চ্যানেল ফোরটিঙ্কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যেন বিদ্রূপ করেই বলেন, সৌদিরা চাইলে সৌদি আরবেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারে, ওদের কাছে অনেক জমি আছে! সপ্তাহের দ্বিতীয় বিবৃতিতে, রিয়াদ আরও কঠোর ভাষায় জানায়, ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজ ভূমির মালিক। তারা কোনো অনুপ্রবেশকারী বা অভিবাসী নয় যে ইসরায়েলি দখলদারেরা ইচ্ছেমতো তাদের উচ্ছেদ করবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোকে তারা চাপের মুখে ফেলে আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়েছিল। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু একদম স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিকভাবে একঘরে করে দেওয়া। এত দিন তিনি সৌদি যুবরাজ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টকে আশ্বস্ত করছিলেন যে ইসরায়েল তাদের মিত্র হিসেবে বিবেচনা করবে। কিন্তু এখন তিনি বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল নিজের শর্তেই ‘শান্তি’ চাপিয়ে দেবে আর আরব বিশ্ব ইসরায়েলের সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।
এমন পরিস্থিতিতে সৌদি পররাষ্ট্রনীতির মোড় ঘুরে গেছে। সে এখন পাঁচ দশক আগের রাজা ফয়সালের আরব জাতীয়তাবাদী অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। ১৫ মাসের নীরবতার পর এখন ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব দেশগুলোর একটি সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গত রোববার গভীর রাতে মিসর ঘোষণা করেছে যে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারা এক জরুরি আরব সম্মেলনের আয়োজন করবে। সম্মেলনের উদ্দেশ্য হবে ট্রাম্পের ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে উচ্ছেদ করে পুনর্বাসনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা।
এই নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ কী? কারণ হলো, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নীতিতে গণহারে ফিলিস্তিনি জনগণকে স্থানান্তরের বিষয়টি যুক্ত হওয়া। গাজার প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোর করে বিতাড়িত করলে তা প্রতিটি আরব দেশকে প্রভাবিত করবে। বিশেষত সৌদি আরবের ওপর এর গভীর প্রভাব পড়বে। ইসরায়েলের আগ্রাসীভাবে এই ভূখণ্ড দখল সমগ্র অঞ্চলকে অস্থির করে তুলতে পারে। আর তা হয়তো এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। এর ভয়াবহ পরিণতি সৌদি আরবের জন্যও বিপজ্জনক হবে।
আরও পড়ুন
সৌদি আরবের সামনে নেতৃত্ব দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
২০১৭ সালে উপসাগরীয় দেশগুলো যে কারণে ফিলিস্তিন সংকটে নীরবতা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছিল, সে পরিস্থিতি এখন আর নেই। অন্যদিকে, সিরিয়ায় অবস্থান হারানোর পর এবং হিজবুল্লাহর সাম্প্রতিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ইরানের প্রতিরোধ জোট দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার বিরুদ্ধে চাপ বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সৌদি আরব। নতুন ইরানি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন উষ্ণ। সৌদি যুবরাজ এমবিএস চান এই সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে।
এমবিএস নিজেও এখন দেশের ভেতর শক্ত ও দৃঢ় পরিস্থিতিতে আছেন। তাঁর ক্ষমতা এখন দৃঢ়। তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি আধুনিক ও সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে জনপ্রিয়। এমবিএসের ক্ষমতার শুরুর দিকে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এখন আর তেমনটা নেই। সব মিলিয়ে ট্রাম্প ও ইসরায়েল থেকে দূরত্ব বজায় রাখার ঝুঁকি সৌদি আরব নিতে পারে। তাহলে তারা নিজেদের নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আবারও আরব ও মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রে নিয়ে আসার সুযোগ পাবে।
এর জবাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চ্যানেল ফোরটিঙ্কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যেন বিদ্রূপ করেই বলেন, সৌদিরা চাইলে সৌদি আরবেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারে, ওদের কাছে অনেক জমি আছে! সপ্তাহের দ্বিতীয় বিবৃতিতে, রিয়াদ আরও কঠোর ভাষায় জানায়, ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজ ভূমির মালিক। তারা কোনো অনুপ্রবেশকারী বা অভিবাসী নয় যে ইসরায়েলি দখলদারেরা ইচ্ছেমতো তাদের উচ্ছেদ করবে।